গল্প-“বন্ধু_চল_রোদ্দুরে”


>> কোল্ড ড্রিঙ্ক এর গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে আড় চোখে একবার বড় হলটার কোণার দিকে দেখে নিল দীপিকা । না এখন আর দেখা যাচ্ছে বদমাশ টাকে । কোথায় গেল ? একটু আগেই তো ছিল ওখানেই । কয়েক মিনিটের মধ্যেই উবে গেল নাকি? যাক , না যেখানে খুশি ।


 মরুক না , তাতে দীপিকার কি ! নিজের মনে মনেই যেন বলে উঠল ও । আসলে ওর মুড টা আজ বেশ অফ । আজকের এত সুন্দর ফ্রেন্ডশিপ ডে পার্টি টায় যেতে পারল না ও শুধু এই খুড়তুতো দেওরের বরযাত্রী সেজে আসার জন্য । কোন মানে হয় ! ওর এই “গুলাবী গ্যাং” ই তো ওর এখনকার নিঃসঙ্গ একঘেয়ে জীবনে বেঁচে থাকার মূল অক্সিজেন।


 ওরা না থাকলে জীবন টা তো আরও বেশি পানসে হয়ে যেত । সত্যি এ কথা অস্বীকার করার তো কোন জায়গাই নেই যে ওর জীবনে ছোট ছোট হাসি খুশি আর আনন্দ উপহার দিয়ে বন্ধু শব্দটাকে ওর কাছে বাঁচিয়ে রেখেছে ওরাই । “গুলাবী গ্যাং” আসলে ওদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের নাম । দীপিকা দের স্কুলের ১৪/১৫ জন মেয়ে হল এই “গুলাবী গ্যাং” এর মেম্বার। প্রত্যেকেই ওদের ব্যাচের । আসলে আজকাল তো সবাই বড্ড ব্যস্ত , সবাই ছুটছে ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় ; বেশির ভাগই তো আবার নিজের শহর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে অন্য শহর বা দেশেও ।


 বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা , হঠাত একদিন আবার সবাই একসাথে দেখা করে এক ঝলক টাটকা বাতাস এর মত আবার সেই পুরনো ফেলে আসা স্কুল বা কলেজের দিনগুলোয় ফিরে যাওয়ার অনুভূতি কে ছুঁয়ে দেখার মত জিনিসের জন্য সময় দেওয়াটাকে অনেকেই বোধ হয় নিতান্ত বোকা বোকা বা সেকেলেপনা মনে করে ।


 তার চেয়ে ডিপ্রেশনে ডুবে সোনালী পানীয়তে সাঁতার কাটাই বোধ হয় তথাকথিত মডার্ন সমাজের কাছে ঢের ভাল । দীপিকা দের ব্যাচের বেশীর ভাগ পাবলিক ই ঠিক এই টাইপের হলেও ১৪/১৫ জন এখনও রয়েছে যারা ঠিক এই দলে পড়ে না ।


 এর বাকিদের মত কথায় কথায় ব্যস্ততার অজুহাত ও যেমন দেখায় না তেমনি নিজেদের ইগো টাকেও বন্ধুত্বের মাঝে টেনে আনে কম । এই কয়েকজন মেয়েই গড়ে তুলেছে নিজেদের এই দল টা । সোশ্যাল নেটওয়ারকিং এর সুবাদের পুরনো লোকজন কে খুঁজে পাওয়া টা তো আজকাল সহজ ই হয়ে গেছে । প্রথমে টুকটাক চ্যাট ই হত সবার মধ্যে , তারপরই একদিন এই কয়েকজন আবিষ্কার করল যে সত্যি ওরা বড্ড একা আর বোর হয়ে গেছে নিজেদের এই হাউজ ওইয়াফ বা গতানুগতিক চাকরী জীবন টাকে নিয়ে । আর তার পরই আস্তে আস্তে তৈরি হয় ওদের “গুলাবী গ্যাং” ।


 ওরা প্রতি মাসে দুবার করে দেখা করে একে অপরের বাড়ি যায় , যতটা সম্ভব নিজেদের সুখ দুঃখের কথা শেয়ার ও করে , সবাই মিলে মুভি দেখে , শপিং করে এই আর কি ! সবচেয়ে মজার কথা হল এই “এই গুলাবী “ গ্যাং এর বেশির ভাগ মেয়েই কিন্তু স্কুল লাইফে মোটেও দীপিকার ভাল বন্ধু ছিল না । ওই শুধু মুখ চেনা ছিল বা টুক টাক কথা হত । কিন্তু আজ এরাই ওর কত কাছের ।


 আর স্কুলে যারা ভাল বন্ধু ছিল তারা সব আজ কত দূরে দূরে । একসময় দীপিকা ভাবত যে বন্ধুরা কাছের ছিল তাদের সাথে কত স্মৃতি ওর ছোটবেলার । তারা তো সেদিন ওর জীবনেরই একটা পার্ট ছিল তাই তারাই যদি আর লাইফে না থাকে তাহলে আর বন্ধুত্বের মানে কি হল ! কিন্তু আজ ও নিজেকের বুঝিয়েছে যে না আসলে যারা জীবনে তোমায় গুরুত্ব দেয় , সঙ্গ দেয় তারাই হল আসল বন্ধু ।


 পুরনো দিন যেমন ফিরে আসে না , তেমনই পুরনো অনেক বন্ধুও আর ফিরে আসে না । কিন্তু আজকের এই “গুলাবী গ্যাং” এর মেয়েদের সাথে এই বন্ধুত্ব টা কি নিছকই নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য আপোষের বন্ধুত্ব নয় ? এই প্রশ্নও উঁকি দেয় ওর মনের মাঝে কখনও । আর ঠিক তখন ই ওর মনে পড়ে যায় তার কথা । আপোষহীন মনের মত বিষাক্ত বন্ধুর থেকে আপোষ করা বন্ধুরা ঢের ভাল তখনই আবার বুঝতে পারে ও । হাজার স্মৃতি , হাজার অনুভুতিকে কতটা পটু হাতে মিথ্যা করে দিয়েছিল সে এটা কি কোনদিন ভুলতে পারবে দীপিকা ? কোনদিন না ।


 বন্ধু শব্দ টার ওপর থেকেই তো বিশ্বাস টাই তো উঠে গেছিল ওর ।


 -“ দেখলে”? শৈবালের গলার স্বরে চটকা ভাংল দীপিকার । শৈবাল ও দেখেছে তাকে । চিনেওছে ঠিক । যদিও শৈবাল শুধু ওর ছবি ই দেখেছে তবুও ভুল করে নি ।


 -“হুম”… ছোট উত্তর দিল দীপিকা ।


 -“ মনে হয় মেয়ের বাড়ির বেশ ক্লোজ কেউ । যাই হোক ইগনোর করবে । পাত্তা দেবে না । যেচে কথা বলতে এলেও একদম এনটারটেন করবে না”। বেশ ভারিক্কি চালেই কথা গুলো বলল শৈবাল ।


 -“হ্যাঁ হ্যাঁ সে আর বলতে ! তাছাড়া ওর সাহস আছে নাকি আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার”! কথাটা বলেই নিজেকে কেমন যেন একটু বোকা মনে হল দীপিকার । কারণ ও যে কথা বলতে আসবে না সেটা ওর সাহসের অভাব আছে বল নয় দীপিকা জানে । আসল কারণ হল আজ দীপিকার জীবনে যেমন ওকে কোন প্রয়োজন নেই তেমনি ওর ও দীপিকাকে কোন প্রয়োজন নেই । ওর ও নিশ্চয় কোন “গুলাবী গ্যাং” আছে ।


 দীপিকার মত ও নিশ্চয় ভুলে গেছে সব পুরনো দিন গুলো । অবশ্য সে সব দিনের দাম কবেই বা ওর কাছে ছিল ? যদি সেটা থাকত তাহলে নিশ্চয় আজ দীপিকার জীবন থেকে ও এত দূরে হয়ে যেত না । 


আজ দীপিকা শুধুই ওকে ঘেন্না করে , ঘেন্না … ঘেন্না…। কি তাই তো ? তাই না? নিজের অবচেতন মনের ই এক চিলতে কোন একটা অপ্রয়োজনীয় চোরা কুঠুরি যেন ফিসফিসিয়ে উঠল দীপিকার কানে কানে “শুধুই ঘেন্না তো ? নাকি একটু আধটু এখনও”… উফফ! এত বেআক্কেলে ভাবনা আসে না মাঝে মাঝে … নিজেকেই যেন ধমকে উঠল দীপিকা ।


 বছর ছয়েকআগে (2)

  -“ কিরে ফোন টা এত ক্ষণ বিজি ছিল কেন তোর”? বেশ মেজাজ দিয়েই প্রশ্নটা করল আদিত্য ।


 -“ না মানে আসলে”… একটু আমতা আমতা করে জবাব দিল পিয়ান । কারণ দীপিকার সাথে কথা হচ্ছিল শুনলেই তো আবার খচে লাল হয়ে যাবে আদিত্য ।


 -“নিশ্চয় ওই ফালতু মেয়েছেলেটার সাথে কথা বলছিলি”? এবার সপ্তমে চড়ে গেল আদিত্যর স্বর ।


 -“ দেখ পিয়ান তোকে আমি আগেও বলেছি , আবারও বলছি ওই বাজে মেয়েটার সাথে তুই মিশবি না । আগে তুই মানিস নি আমার কথা , তবু আমি চুপ থেকেছি । কিন্তু আর নয় । এবার মাত্র কয়েকদিনের পরেই তুই বউ হচ্ছিস আমার তাই এই কথাটুকু তোকে শুনতেই হবে”।


 -“ প্লিজ আদি , তুই একটু বোঝ । ও বাজে মেয়ে নয় । ওর যে খারাপ ছবি টা ইন্টারনেটে বেরিয়েছে সেটা আদৌ ও নয় । কেন তুই মানতে চাইছিস না”?


 -“ এই শোন পিয়ান একদম বাজে কথা বলবি না । এসব ফালতু কথা যে মানে মানুক কিন্তু আমি একটু ও মানব না বুঝলি । আর ওই ছবির কথা ছাড় , কৃশানুর সাথে যে দিনের পর দিন ও সস্তার গেস্ট হাউজে গিয়ে কি নষ্টামি করেছে সেটা তো কলেজ শুদ্ধ সবাই জানে । কি বলবি তুই এ ব্যাপারে”?


 -“ এখানে ওর কি দোষ ? কৃষাণু দা ই তো ইউজ করেছে ওকে খারাপ ভাবে ।“


 -“ কৃশানু তো বাজেই । কিন্তু এর মানে এই নয় যে ওই মেয়েটার নষ্টামি ঢেকে গেল। যে মেয়ে একবার নিজের সতীত্ব দান করতে পারে সে হাজার বার ও পারে । আমি সত্যি বুঝি না এমন একটা মেয়েছেলে কি করে বন্ধু হল তোর ? তবে যাই হোক এমনিতেও আর ওর সাথে তোর বন্ধুত্বের মেয়াদ শেষ ওমনিতেও শেষ । যখন ও দেখবে যে শুরশুর করে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড বিয়ে করে নিল আর ও জানতেই পারল না তখন কি আর তোদের বন্ধুত্ব থাকবে নাকি?” এবার অদ্ভুত ভাবে হাসল আদিত্য ।


 -“ প্লিজ আদি , প্লিজ এভাবে বলিস না । ওকে বিয়েতে নেমন্তন্ন না করাটা কি করে হয় বলতো ? এতদিন তো আমি তোর সব কথাই মেনেছি”।


 -“ তার মানে”? এবার প্রায় গর্জন করে উঠল আদিত্য ।


 -“শোন পিয়ান ঐ মেয়েকে আমি যদি বিয়েবাড়িতে দেখি তাহলে সেই মুহূর্তে আমি বেরিয়ে যাব । তার পর যা হয় হবে । আর তুই আমার রাগ আর জেদ জানিস । আমি ভালোর ভাল আর খারাপের খারাপ । সুতরাং যা করবি ভেবে করবি”।


 -“ আদি একটু শোন আমার কথা”… পিয়ানের কথা শেষ হবার আগেই কট করে কেটে গেল ফোনের লাইন । আর জলভরা চোখে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল মেয়েটা । কি করে ও বোঝাবে আদিত্যকে যে বন্ধুত্ব কোন নির্দিষ্ট যুক্তি মেনে চলে না। ভাল খারাপের এত তথাকথিত সংজ্ঞা খাটিয়ে বন্ধুত্ব বাঁচে না । দীপিকা যে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড । আর অলরেডি আদির কথা মানার জন্য অনেক ছল চাতুরী ও করেই ফেলেছে দীপিকার সাথে । কি যে খারাপ লাগে ওর ও কাকে আর বোঝাবে সেটা । আচ্ছা তবে এই কি শুরু ওর পুরুষের হাতে নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন করা ?


 দীপিকার সাথে আলাপের প্রথম দিনটা আজ ও মনে আছে ওর । না , খুব বিশেষ নাটকীয় কিছু ঘটে নি সেদিন । কলেজের প্রথম দিন সবাই সবার সাথে পরিচয় করছিল খুব সাধারণ ভাবেই । তখনই পরিচয় হয়েছিল । জিন্স টপ পরিহিতা , ঘাড় অবধি ছোট করে ছাঁটা চুলের ওই মেয়েটা যে গতানুগতিক আর পাঁচটা মেয়ের থেকে কিছুটা আলাদা সেটা পিয়ান বুঝতে পেরেছিল প্রথম আলাপেই । আর সেই ধারণা টা যে খুব একটা ভুল নয় সেটা টের পেয়ে গেছিল ও প্রথম দিনেই । সিনিয়র রা যখন বেশ রগড়ে দেওয়া ৱ্যাগিং করছিল তখন সত্যি পুরো ব্যাপারটা বেশ কুল আর স্মার্ট ভাবেই হ্যান্ডেল করেছিল দীপিকা । খুব ভাল লেগেছিল পিয়ানের । যদিও ও নিজে ঠিক এমন টা নয় , তবুও মেয়ে যেন এমনই হওয়া উচিত । চাবুকের মত ।


 আস্তে আস্তে কিভাবে কে জানে দীপিকার সাথে একটু একটু করে ঘনিষ্ঠতা হচ্ছিল ওর । কি ভাবে আর কেন যে কাছাকাছি এসে গেছিল ওরা সেটা আজ ও অজানা পিয়ানের । দীপিকা মেয়েটা সত্যি খুব বিন্দাস টাইপের । জীবন কে দেখার ওর দৃষ্টি ভঙ্গিটাই আলাদা । স্মোক করে , মাঝে মাঝে টুকটাক ড্রিঙ্ক ও করে । ও নিজের সব কথা শেয়ার করত পিয়ানের সাথে । আর আগে দুটো প্রেম করেছিল ও । প্রথম চুম্বনের অভিজ্ঞতা , প্রথম কাছাকাছি আসার অভিজ্ঞতা এই সব । পিয়ানের জীবনে তখনও পর্যন্ত বলার মত বিশেষ কোন ঘটনা ও ছিল না আর বিশেষ কোন মানুষ ও ছিল না । তাই তখন ও বলত কম আর শুনত বেশি । মাঝে মাঝে বলত টুকটাক নিজের ক্রাশ টাশ এর কথা । এভাবেই চলছিল ওদের কলেজ জীবন আর বন্ধুত্ব । দীপিকার বিন্দাস নেচারের জন্য অনেকেই ওকে ঠিক সুবিধার চোখে দেখত না । কিন্তু তাতে কোনদিনই কিছু যেত আসত না পিয়ানের । ওর কাছে দীপিকার বন্ধুত্ব যেন ছিল ওর বেশ রক্ষণশীল জীবনে এক ঝলক টাটকা বাতাস । ওর মজার মজার জোকস , ওর আন্তরিক ব্যবহার আর সবচেয়ে বড় কথা ওর সহজেই সবাইকে বিশ্বাস আর আপন করে নেবার স্বভাব টা বড্ড ভাল লাগত পিয়ানের ।


 কিন্তু সেই দীপিকাই কি ভাবে যেন প্রেমে পড়ে গেল কৃশানু দা’র। কৃশানু ছেলেটা যে একটু অতিরিক্ত ঝানু সেটা কলেজের অনেকের মত তো জানতই দীপিকা কিন্তু তবুও কেন যে ওর প্রেমে ও পড়ে গেল কে জানে ! এই জন্যই বোধ হয় বলে “ কার কিসে মজে মন / কিবা চণ্ডাল কিবা ডোম”।


 -“ তুই কিনা শেষে কৃশানুর সাথে প্রেম করছিস ? সবাই বলে ছেলেটা ভাল না “…… বেশ অবাক হয়েছিল পিয়ান ওদের প্রেমের সংবাদ টা প্রথম পাবার পর ।


 -“ ছাড় তো লোকের কথা । তুই জানিস ই যে আমি লোকের কথায় খুব একটা পাত্তা দি না । আমার তো মনে হয় নি ও খারাপ। যদি নিজে কোনদিন বুঝতে পারি তাহলে দেখা যাবে । তাছাড়া এটা তো মানবি যে সত্যিকারের ভালবাসা পেলে অনেক ডেঁপো ছেলেও সোজা লাইনে এসে যায় । কৃশানু তেমনই রে । ও চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে”।


 না , দীপিকার ধারণা আর বিশ্বাস সব ই মিথ্যে করে দিয়েছিল কৃশানু । সে কোন সোজা লাইনে আসে নি । উল্টে তাকে বিশ্বাস করে দীপিকাই খুইয়েছিল নিজের কুমারীত্ব । খুব বিচ্ছিরি ভাবে ব্রেক আপ টা হয়েছিল ওদের । খুব খারাপ ভাবে সেবার সারা কলেজে বদনাম হয়ে গেছিল দীপিকা । কৃশানু যেন পুরো দায়িত্ব নিয়ে ছড়িয়েছিল দীপিকার বদনামি । শুধু তাই নয় দীপিকাকে কি সব ব্ল্যাক মেল ও করেছিল নচ্ছার ছেলেটা । ওদের কি সব ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি নাকি কৃশানু ছেড়ে দেবে ইন্টারনেটে । খুব ভেঙ্গে পড়েছিল দীপিকা । কান্না ভেজা চোখে বারবার বলেছিল – “ ওকে মন উজাড় করে করে ভালবেসেছিলাম , নিজের সবটুকু দিয়ে বিশ্বাস করেছিলাম । সেটাই কি তবে দোষ হয়েছিল আমার? যাকে মন থেকে এত ভালবেসেছি তাকে বিশ্বাস করব নাই বা কেন বলতো “?


 সেই সময় নিজের বন্ধুত্বের ভালবাসার সুঘ্রাণ দিয়ে ওকে সাধ্যমত সামলেছিল পিয়ান । কিন্তু ততক্ষনে পিয়ানের নিজের জীবনেও যে ঘটে গেছে অনেকখানি উথাল পাথাল সেটা তখনও বলে নি ও দীপিকাকে । আদিত্য তখন সমুদ্রের আচমকা ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়েছে পিয়ানের জীবনে । আদিত্য কলেজের নামকরা ছেলে । যেমনই পড়াশুনায় ব্রিলিয়ান্ত , তেমনি কুইজে পারদর্শী আর তেমনি সুন্দর তার চেহারা । মেয়েদের লম্বা লাইন এই আদিত্যর পিছনে । পিয়ানের ও বেশ লাগত ছেলেটাকে , যদিও পিয়ানকে ভাল লাগার তেমন কোন কারণ আদিত্যর দিক থেকে মোটেই ছিল না ।


 তবুও কিছু ঘটনা হয়তো ঘটেই যায় , যেগুলোর আপাতদৃষ্টিতে কোন কারণ থাকে না । আদিত্য আর পিয়ানের প্রেম টা কতকটা সেরকমি । কি ভাবে যেন আদি ও প্রেমে পড়ল পিয়ানের ই । পিয়ানের চোখে তো তখন স্বপ্নের ঘোর । বিশ্বাসই হচ্ছে না যেন সবটা । ওদের সম্পর্কের শুরু থেকেই আদিত্যর একটা দাবী ছিল । কলেজের কাক পক্ষীও যেন টের না পায় ওদের প্রেমের কথা । অতি কষ্টে অর্জিত নিজের গুড রেপুটেশান নিয়ে বরাবরই খুব সতর্ক ছিল আদি । তাই পিয়ান কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল সে যেন আদি না বলা পর্যন্ত কাউকেই পিয়ান না জানায় ওদের সম্পর্কের কথা । আবেশ লাগা চোখে তখন ওর সব কথাই মেনে নিয়েছিল পিয়ান।


 তবে দিন যত যেতে থাকল ত্ত পিয়ান বুঝতে পারল দীপিকাকে বড্ড বেশি অপছন্দ আদির । তাই কলেজ পার করে ইউনিভার্সিটি যাবার পরেও আদিত্য অ্যাপ্রুভ করল না ওদের রিলেশান টা দীপিকাকে জানানোর ব্যাপারটা । পিয়ানের সব অনুরোধ বাতিল হয়ে গেল আদির জেদের কাছে । কিন্তু দীপিকা যে পিয়ানের বেস্ট ফ্রেন্ড । তাই ও যে ভীষণ ভাবে চাইত নিজের ভালবাসার , ভাললাগার অনুভুতি গুলোকে শব্দে গেঁথে দীপিকার সাথে ভাগ করে নিতে । সেটা করেছিল ও । শুধু নিজের বয় ফ্রেন্ডের নাম আদিত্য থেকে বদলে অপূর্ব করে নিয়েছিল ।


 আর যেহেতু আদিত্য তখন ওদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ত না , তাই অসুবিধাও হয়নি বিশেষ । পিয়ানের আবার ফেস বুক , অরকুটের ভালবাসা টাও তখন গজায় নি তেমন , সেটা ছিল আর এক সুবিধে । তাছাড়া মানুষকে চোখ বুজে বিশ্বাস করা টা তো বোকা দীপিকা টার স্বভাব । কৃশানুকেই যে অবিশ্বাস করতে পারে নি সে আর নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে কি অবিশ্বাস করবে ! তাই এই লুকোচুরি করে মোটামুটি পেরিয়ে গেল ইউনিভার্সিটির দুটো বছর ও । সেই গণ্ডি পেরনোর খুব অল্প দিনের মধ্যেই দীপিকা পাড়ি দিল দিল্লী । কি একটা ম্যানেজমেন্ট কোর্স করতে এক বছররের জন্য । আর এই সময়টাতেই ঠিক হয়ে গেল পিয়ান আর আদিত্যর বিয়েটা ।


 আদিত্য বিদেশ যাচ্ছে তিন বছরের জন্য , তাই সবার ইচ্ছে সে বউ নিয়েই যাক । কিন্তু এবার কি করবে পিয়ান ? আদি যে এখনও কিছুতেই দীপিকাকে মানছে না । এখনও ওদের সম্পর্কের কথা , বিয়ের কথা না জানানোর জন্য ভয়ানক দিব্যি দিয়ে রেখেছে ওকে । বলছে বিয়েতেও ডাকতে দেবে না ওকে । কিন্তু এটাও কি সম্ভব ? কেন যে পিয়ান পারে না আদিকে বোঝাতে ? কেন যে পিয়ান বারবার হেরে যায় আদির ব্যক্তিত্বের চাবুকের সামনে ! দীপিকা ছাড়াই হয়ে যাবে পিয়ানের বিয়ে । অথচ কলেজ ছুটির পরে কতদিন বিকালে ওরা কলেজ স্ট্রীট মোড়ের ওই বড় বেনারসি দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বিয়ের সাজ নিয়ে, বিয়ের প্ল্যান নিয়ে কাল্পনিক বক বক করে গেছে অজস্র ।


 -“ তোর বেনারসি আমি পছন্দ করব আর আমার টা তুই”। সব সময় বলত দীপিকা । আর সেই দীপিকাকে ছাড়া ই বিয়ে করে নেবে আজ পিয়ান ? এত বড় জিনিস লুকানো যায় নাকি । যদিও এটা ঠিক যে ওর সাথে কলেজের বিশেষ কারো আর যোগাযোগ নেই এখন , কিন্তু তবুও …… আর বিয়ের পরে ? কি করে চেপে রাখবে পিয়ান নিজের বিয়েটা ওর সামনে ? দীপিকা কি আর জীবনেও ওর মুখ দেখবে যদি ও জানতে পারে যে পিয়ান নিজের বিয়ে থেকে , নিজের জীবনের সব চেয়ে বড় সময়টা থেকে এভাবে সরিয়ে রেখেছিল ওকে । তার মানে ওদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে । না চাইতেও পিয়ান দীপিকার চোখে একটা নরকের কীটে পরিণত হবে । দীপিকা ঘেন্না করবে ওকে এর পর থেকে সারাজীবন !