অজস্র ভালোবাসার কষ্ট


আমার বাসর রাত।বিছানার ঠিক মাঝখানে নববধূ বসে আছে। মাথায় লম্বা ঘোমটা দেওয়া। আমি বিছানার এক কোণায় বসে আছি। রুমে এসি চলছে তবু ঘামছি। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড এমন ভাবে লাফাচ্ছে, মনে হচ্ছে ড্রাম বাজছে। চেষ্টা করছি কিন্তু মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সব কথাই ভুলে গেছি। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা। অথচ এমন হওয়ার কথা না। আমি যথেষ্ট সাহসী ও স্মার্ট একটি ছেলে। তা ছাড়া, এই বাসর রাতের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতিও নিয়েছি। বাংলা সিনেমার বাসর ঘরের সিনগুলো বারবার দেখেছি এবং বিভিন্নজনের কাছ থেকে অনেক পরামর্শ নিয়েছি। সবচেয়ে বেশি পরামর্শ পেয়েছি আমার ভাবির কাছ থেকে। তবে তিনি একজন বোকা টাইপের সহজ সরল মহিলা। আর তার অধিকাংশ পরামর্শই ছিল উদ্ভট ও ভয়ংকর।  


: শোন বাসর রাতেই কিন্তু বউকে ঠিকমতো টাইট দিবি।  


: তুমি যখন বলেছ, অবশ্যই দেব। কোনো ছাড়াছাড়ি নাই। কিন্তু কী দিয়ে টাইট দেব? প্লাস, স্ক্রু ড্রাইভার, নাকি রেঞ্জ দিয়ে।  


: সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করবি না। মনে রাখিস বাসর রাতেই বিড়াল মারতে হবে। না হলে সারা জীবন কিন্তু বউয়ের কথায় ওঠবস করতে হবে।  


: করলে সমস্যা কী! ওঠবস করা একধরনের ব্যায়াম। শরীর ভালো থাকবে।  


: ফাজলামি করবি না। একটু সিরিয়াস হ।  


: ওকে আমি সিরিয়াস। কিন্তু বিড়াল যে মারব তা বিড়াল পাব কোথায়? আর ভাবি, এরা এ যুগের মেয়ে এদের এমনিতেই ভয় ডর কম। বিড়াল মারলেও কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। যদি বাঘ–টাঘ জাতীয় কিছু মারতে পারতাম, তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাঘ পাব কোথায়? আচ্ছা ভাবি তোমার জানাশোনা কোনো ফার্ম আছে? যেখানে বাঘ বিক্রি করে। আমার মাথায় একটা সিরিয়াস আইডিয়া এসেছে। ধরো বিয়ের দিন একটা বাঘ খাঁচাসহ কিনে এনে বাসর ঘরে রেখে দেব। তারপর রাতে টারজানের মতো শুধু লাল রঙের একটা জাঙিয়া পরে বাসর ঘরে ঢুকব। রুমে ঢুকেই কোনো কথা নাই। প্রথমেই মুখের কাছে দুই হাত এনে টারজানের মতো ওওওওওওওওও...বলে একটা চিৎকার দেব। তারপর নতুন বউয়ের সামনে জংলিদের মতো নেচে নেচে বল্লম দিয়ে বাঘটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব। এরপর বাঘের ডেড বডির ওপর দাঁড়িয়ে আবার ওওওওওওওওও.... বলে চিৎকার দেব। আমি এক শ ভাগ নিশ্চিত বউ ভয় পাবেই। এমনকি ভয়ে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।  


খেয়াল করলাম, ভাবি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।  


: এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?  


: তোরে বুদ্ধি দিতে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।  


: ভাবি একটা কথা, জাঙ্গিয়াটা লাল পরব নাকি হলুদ?  


: তুই দুর হ আমার সামনে থেকে।  


বাসর ঘরে এভাবে বেকুবের মতো বসে থাকার কোনো মানে হয় না। সিদ্ধান্ত নিলাম কোনো একটা অছিলায় রুম থেকে বের হয়ে পালিয়ে যাব। তারপর রাতে আর বাসায় ফিরব না। বিছানায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার সামনে যেতেই পেছন থেকে মাস্টারনির মতো কণ্ঠে বলে উঠল, কোথায় যাচ্ছ?  


মাইগড প্রথমেই তুমি! কোথায় ভেবেছি প্রথমে আপনি করে বলবে। আর আমি বারবার অনুরোধ করে বলব, আপনি না তুমি বলো। কিছুই তো দেখি পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছে না। ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখলাম এখনো ঘোমটা দিয়েই বসে আছে।  


: বললে না কোথায় যাচ্ছ?  


: টয়লেটে যাব।  


: ঠিক আছে, কিন্তু বাইরে যাচ্ছ কেন? টয়লেট তো রুমের মধ্যে।  


: তাই নাকি? টয়লেট রুমের মধ্যে?  


: তোমার বাসা আর তুমি আমাকে প্রশ্ন করছ!  


: তাই তো এটাতো আমারই বাসা। বুঝছি না, কেন জানি সবকিছু ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।  


: তাই! আচ্ছা যাও, টয়লেট থেকে ঘুরে আসো।  


: এখন তো টয়লেটে যেতে ইচ্ছে করছে না।  


: আচ্ছা ইচ্ছে না করলে যেতে হবে না। এদিকে আসো সামনে এসে বস।  


ভয়ে ভয়ে বিছানার এক কোণে গিয়ে বসলাম।  


: ওখানে বসেছ কেন? আমার সামনে বস।  


সামনে গিয়ে বসলাম। হৃৎপিণ্ডের গতি আরও বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বেড়ে গেল ঘামের গতি। মনে হচ্ছে প্রতিটি লোমকূপে একটি করে পানির নল বসানো হয়েছে। টের পাচ্ছি শেরওয়ানির নিচে পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। সে এক বিশ্রী অবস্থা।  


: তোমার সমস্যাটা কি? গত আধা ঘণ্টা থেকে লক্ষ্য করছি তুমি কেমন জানি অ্যাবনরমাল আচরণ করছ।  


: আমারও তাই মনে হচ্ছে। কেন জানি সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আসলে প্রথম বিয়ে তো তাই।  


: প্রথম বিয়ে মানে! তোমার কি আরও বিয়ে করার ইচ্ছে আছে?  


: নাউজুবিল্লা। এটা কী বললা। আসলে নার্ভাস তো তাই কী বলতে যে কী বলছি বুঝতে পারছি না।  


: ইটস ওকে। আচ্ছা আমি আর কতক্ষণ এভাবে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকব বলতে পার? আমার ঘাড় ব্যথা করছে।  


: তাই নাকি! আসো তোমার ঘাড় টিপে দিই।  


: আমি কি তোমাকে ঘাড় টিপতে বলেছি!  


: না তা বলো নি। ঠিক আছে বলো আমাকে কী করতে হবে।  


: তোমাকে কিছুই করতে হবে না।  


বলেই ঝামটা দিয়ে ঘোমটা খুলে ফেলল।  


হায় খোদা সব সময় ভেবেছি, বাংলা সিনেমার মতো বাসর রাতে আমি ঘোমটা খুলব, সে লজ্জায় জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকবে। আমি চিবুকে হাত দিয়ে বলব, চোখ খোলো লক্ষ্মীটি, আমার দিকে তাকাও। তা না সে নিজেই ঘোমটা খুলে ফেলেছে।  


: কী হলো, নিচের দিকে তাকিয়ে আছ কেন? আমার মুখের দিকে তাকাও।  


বউয়ের মুখের দিকে তাকালাম। মনে হলো আমার সামনে এক অপ্সরী বসে আছে।  


: চুপ করে আছ কেন? বলো আমাকে দেখে কেমন লাগল।  


: বুঝতেছি না।  


: মানে কি!  


: না, আসলে ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি অনেক সুন্দর।  


: তাহলে মাশ আল্লাহ বল।  


: মাশ আল্লাহ, সুবহান আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।  


: এত বেশি বলতে হবে না।  


: তোমাকে দেখে অনেক খুশি হয়েছি তো, তাই সবকিছু এক সাথে বের হয়ে গেছে।  


: খুশি হয়েছ? তাহলে যাও এখন দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় কর।  


: এখনই পড়তে হবে?  


: হ্যাঁ এখনই পড়তে হবে।  


: শোনো এই রুমে তো জায়নামাজ নাই। জায়নামাজ ছাড়া নামাজ পড়াটা ঠিক হবে না।  


: সমস্যা নাই। আমার সুটকেসের মধ্যে জায়নামাজ আছে। বের করে দিচ্ছি।  


বউ সুটকেস থেকে জায়নামাজ বের করে দিল। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষ করে মোনাজাত ধরতে যাব ঠিক তখনই বউ বলে উঠল।  


: অজু করেছিলে?  


: না।  


: অজু ছাড়াই নামাজ শেষ করে ফেললে?  


: ও মাই গড অজু করার কথা মনেই ছিল না। তবে সমস্যা নাই। আল্লাহ এই সব ছোটখাটো ব্যাপার ধরেন না। উনি মহান।  


: নিজে নিজে হাদিস বানিয়ো না। যাও অজু করে আবার নামাজ পড়। আরেকটি কথা, আজ সারা দিনে কয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েছ?  


: আজ পড়িনি।  


: কেন?  


: মনে হয় বিয়ের টেনশনে।  


: বিয়ের টেনশনে নাকি খুশিতে?  


: সম্ভবত দুটোই।  


: শোনো বিয়ে করছ এটা অবশ্যই খুশির ব্যাপার। কিন্তু এই খুশিতে তো আর নামাজ বাদ দিতে পারবে না। সে জন্য এখন দুরাকাত নফল নামাজ তো পড়বেই তার সাথে সারা দিনের সব কাজা নামাজও পড়বে।  


: মাই গড! বলো কী। সারা দিনের এত নামাজ পড়তে পড়তে তো রাতই শেষ হয়ে যাবে।  


: শেষ হলে হবে। কোনো সমস্যা আছে?  


: অবশ্যই আছে। এটা আমার বাসর রাত। এটা শবে বরাতের রাত না যে, সারা রাত নামাজ পড়ব।  


: শোনো, নামাজ কালাম নিয়ে কখনো ফান করবে না।  


: আচ্ছা করব না।  


: দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও নামাজ শেষ করো। আমি এর মধ্যে বিয়ের পোশাক চেঞ্জ করে একটু ফ্রেশ হই। তা কী পরব?  


: মানে কি?  


: মানে আমি তোমার পছন্দের পোশাক পরতে চাচ্ছি। এখন বল শাড়ি পরব নাকি সালোয়ার কামিজ?  


: শোনো আমার রুচি তোমার পছন্দ হবে না।  


: পছন্দ না হলেও বলো শুনি।  


: একবার একটা বাংলা সিনেমায় দেখেছিলাম অঞ্জু আপা লুঙ্গি আর শার্ট পরেছে। তুমি...।  


কথাটা শেষ করতে পারলাম না। দেখলাম আমার দিকে কেমন ভাবে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কি এখন আমাকে তোমার অঞ্জু আপার মতো লুঙ্গি পরতে বলছ!  


: দেখ, আমি তো আগেই বলেছি আমার রুচি তোমার পছন্দ হবে না। অবশ্য তুমি চাইলে আরেকটি ইউনিক আইডিয়া দিতে পারি।  


: না। তোমার ইউনিক আইডিয়া আর শুনতে চাচ্ছি না। তুমি যাও নামাজ শেষ কর।  


বিসমিল্লাহ বলে নামাজ শুরু করলাম। নামাজ শেষ করে দেখি বউ বিয়ের পোশাক পাল্টে নীল একটা শাড়ি পরে বসে আছে।  


: কেমন লাগছে আমাকে?  


: নীল পরির মতো লাগছে।  


: তাই। তুমি কি কখনো পরি দেখেছ? 


: না দেখিনি।  


: তাহলে কী করে বুঝলে আমাকে পরির মতো লাগছে।  


: সরি ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে পরির মতো লাগছে না।  


: তার মানে কী!  


বলেই রিনিঝিনি করে হেসে উঠল।  


: না মানে আমি বলতে চেয়েছি, তোমাকে পরির চেয়েও সুন্দর লাগছে।  


: ধন্যবাদ। আচ্ছা তোমার কি আমার হাত ধরতে ইচ্ছে করছে?  


: একটু একটু করছে।  


: ধরতে চাইলে ধরতে পার। তবে তার আগে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে।  


: বুঝলাম না। তোমার হাত ধরার জন্য কেন আমাকে টাকা দিতে হবে? তাও আবার ৫০ হাজার!