বন্ধুত্বের গল্প-জীবনের আয়না

>> আজ সকাল থেকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র একটা গান মাথায় ঘুরছে। মাঝে মাঝে আমার এরকম হয়। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ করে বেমক্কা এক-আধটা গানের কলি মাথায় উদয় হয়, আর সারাদিন ধরে খোঁচাতে থাকে।

 একদিন যেমন, ‘জেহের হ্যাঁয় কে প্যার হ্যাঁয় তেরা চুম্মা’ গানটা মাথায় ফেঁসে গিয়েছিল! সারাদিন কী নিদারুণ অবস্থা – না পারছি গানটাকে মাথা থেকে তাড়াতে, আর অফিসে থাকার দরুণ না পারছি গানটাকে শুনতে, যদিও গানটা অতীব অখাদ্য এবং নর্মাল অবস্থায় সেটা শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার হওয়ার কথা নয়।

 কিন্তু মাথার ভেতরে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা গানের গুঁতোকে সামলাতে হলে সেটাই একমাত্র কার্যকরী ওষুধ, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। তাই সারাদিন বিষাক্ত প্রেমের চুমু (বা, প্রেমের বিষাক্ত চুমু)-র খোঁচায় অতিষ্ঠ হয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরে গানটা শুনে মুক্তি পেয়েছিলাম।

  সত্যিই, শানুদা কীসব গান গেয়ে গেছেন আমাদের জন্য!
  আজকের গানটা অবশ্য আমার খুব প্রিয় গান, গানের কথাগুলোও বেশ দার্শনিক। যে লাইনটা আমার মাথায় আটকে আছে, সেটা হল ‘হাত বাড়ালেই, বন্ধু সবাই হয়না/ বাড়ালে হাত, বন্ধু পাওয়া যায়না’…। 

অনেক ভাবার চেষ্টা করলাম এরকম একটা অফ্‌বিট গান মনে পড়ার কারণ কি, কিন্তু অনেক মাথা চুলকেও কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। গানটা একবার শুনে নিলেই ল্যাঠা চুকে যেত, কিন্তু মনে হল সেটা না করে বরং বন্ধুদের সম্পর্কেই কিছু বলা যাক। তাতে আর কিছু হোক না হোক, আমার নিজের খুব ভাল লাগবে।

  বন্ধু এবং বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক বাঘা-বাঘা লোক অনেক বাঘাটে-বাঘাটে কোটেশান দিয়ে গিয়েছেন, সেসব সবাই জানে। আমার কাছে বন্ধু মানে হল সেই মাল, যার সঙ্গে একদিন বাদে কথা হোক কি এক যুগ বাদে, কথার টোনটা ঠিক আগের মতই থাকবে, আর বাক্যালাপ শুরু হবে ঠিক তার পর থেকে, এক যুগ (বা একদিন) আগে যেখানে শেষ হয়েছিল।

  তবে মহীনের গানের কথাগুলোর সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত – বন্ধু সবাই হয়না, আর সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায়ও না। এই বিষয়েও নানা মুনি নানা মত দিয়ে গেছেন, আমি সেসবে যাচ্ছি না, আমি বরং আমার কয়েকজন বন্ধুর কথা বলি।

  গবার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। কলেজের প্রথম বা দ্বিতীয় দিন তখন, ফিজিক্স পাসের ক্লাস চলছিল। একজন খেঁকুরে-টাইপ ম্যাডাম পড়াচ্ছিলেন, আর আমি যথারীতি লাস্ট বেঞ্চের আগের বেঞ্চে বসে বোর হচ্ছিলাম। 

হঠাৎ শুনতে পেলাম পেছনের বেঞ্চ থেকে উত্তাল খিস্তিমেশানো কিছু বুলি ভেসে আসছে, যার কিছু স্যাম্পেল ছিল এরকম – ধুর বা…, এসব কি চলছে; ওরে গা…, চুপ করো না; অ্যাই বোকা…, ইকোয়েশনটা ভুল লিখেছিস; ধুশ্লা, সব শালা ***** (লেখার অযোগ্য) ইত্যাদি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, একটা লাল্টুসমার্কা ছেলে একা একাই বকে যাচ্ছে।

 কৌতূহল হল, বেঞ্চিবদল করে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। বাকিটা, ইতিহাস! দেড়যুগ কেটে গেছে, গবার খেউড় এখনও চলছে, আর আমার কৌতূহলও, যে কি করে (বা কেন) একটা আধদামড়া মাল বিনা কারণে এরকম খেউড় করতে পারে!

  আসলে গবার মধ্যে একটা অদ্ভুত ছেলেমানুষি সারল্য আছে, যেটা ঢাকা দিতেই ওর এই খেউড়পনা।

 গবার সঙ্গে কথা শুরুর আগে আমরা সবাই ওকে তিনমিনিট ছাড় দিয়ে থাকি – সে সামনাসামনিই হোক কি ফোনে, কেননা সেই তিনমিনিটে ও ওর জানা খানতিরিশেক খিস্তি দুটো লূপে চালিয়ে নেয়। সেকেন্ড লূপের শেষভাগে ও পৌঁছলে আমরা রেডি হয়ে থাকি, তারপর লূপ শেষ হলে বলি, “এবার বল, কেমন আছিস?”

  খিস্তির লূপ চালানোটা বাদ দিলে অবশ্য গবার মধ্যে প্রচুর ভালভাল গুণ আছে। ছেলে হেব্বি রান্না করে (ডালসেদ্ধ থেকে পাঁঠার মাংস অবধি ওর রেঞ্জ, মানে বিশাল আর কি), খুব ভাল ঘর গোছাতে পারে,

 পরিপাটি করে বাথরুম আর রান্নাঘর পরিষ্কার করতে পারে, সিভ্যাস রিগ্যালের মতন বস্তুকে রু-আফ্‌জা আর অরেঞ্জ জুস দিয়ে ককটেল বানিয়ে খেতে পারে, খুব ভাল গুল মারতে পারে, আর হ্যাঁ, মালটা কিশোরকুমার-শচীন তেন্ডুলকার-নচিকেতা-সুনীল গাঙ্গুলীর বিশাল ভক্ত।

  গবার গুল মারার ক্যাপা লেজেন্ডারি। একবার হিউস্টন থেকে ফিরে এসে বলেছিল যে ওখানে গ্যালেরিয়া নামের একটা মল্‌ আছে, যেটা নাকি ১২২ তলা উঁচু।

 পরে যখন আমরা সেখানে গিয়েছিলাম, দেখা গিয়েছিল কে যেন উপরের ১১৯টা তলা হাওয়া করে দিয়েছে! এই কথা গবাকে বলাতে ও বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলেছিল, “ওঃ, তাহলে ওটা না, বুঝলি? ওর পাশের বাড়িটা…কী বিশাল উঁচু না?”

  তবে গবার গৃহকর্মে এবং রন্ধনশিল্পে নৈপুণ্যের জন্য ওর বৌ মাসির মনে গর্বের অন্ত নেই!

  গবার বৌ, অতএব ওর নাম গোবি হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু আমরা ওকে মাসি বলেই ডাকি। যদিও মাসি পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশানে আমাদের ক্লাসমেট ছিল, কিন্তু ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা হয়েছিল মার্কিনমুলুকে গিয়ে।

 তবে সত্যি বলতে কি, মাসি বন্ধু কম, গার্জেন বেশী। বিদেশে গিয়েই টের পেয়েছিলাম ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ কথাটার আসল মানে কি। মাসি নিজের দায়িত্বে আমাদের সবাইকে আগলে আগলে রাখত, দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করে আমাদের খোঁজখবর নিত।

 তখন বয়েস কম আর রক্ত ফুটন্ত ছিল, তাই হুল্লোড়বাজিটা স্বাভাবিকভাবেই লাগামছাড়া ছিল। মাসি কিন্তু বেচাল দেখলেই ফোনে আমাদের বিশাল ধমকধামক দিত, আর আমরা সেটা বেশ উপভোগ করতাম।

  মাসির এই কনসার্ন অবশ্য শুধু বন্ধুমহলেই সীমাবদ্ধ নয়, আধাচেনা, সিকিচেনা এমনকি একবারই মাত্র দেখা হয়েছে, এমন লোকের জন্যেও ও বেশ চিন্তাটিন্তা করে, অনেকটা ওই ভগিনী নিবেদিতা টাইপের ব্যাপার আর কি! তবে মাসির বন্ধুদের সার্ক্লটা বিশাল।

 সাক্ষাতে বা ফোনে গল্পগুজব চলছে, কেউ হয়ত কারো একটা নাম বলল, ওমনি মাসি বলে উঠত, “ওকে আমি চিনি, ও…” বলে সেই ব্যক্তির একটা ব্রিফ হিস্ট্রি দিয়ে দিত আমাদের। তখনও ফেসবুক-লিঙ্কড্‌ইন এরকম ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায়নি, তাই মাসিই ছিল আমাদের ফেসবুক-কাম-লিঙ্কড্‌ইন।

  মাঝেমাঝেই মাসির মধ্যে সাংস্কৃতিক হওয়ার একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। একবার যেমন প্রবলবেগে জয় গোস্বামী-শঙ্খ ঘোষ পড়া আরম্ভ করেছিল। কিন্তু যে কবিতাগুলো বুঝছিল না, সেগুলো ওকে বোঝাবে কে? 

আমাদের দৌড় তো ওই ‘কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি’ অবধি! অন্য গ্রুপের বন্ধুদের সাহায্যে কিছুদিন ম্যানেজ করেছিল, অবশেষে ক্ষান্ত দেয়। ইদানিং মাসি ছবি আঁকায় মন দিয়েছে, ওর আঁকার হাতটাও খারাপ নয়। দেখা যাক এটা কতদিন চলে।

  তবে এতকিছু ভালভাল গুণের মধ্যে মাসির একটাই দোষ – ওর ইমোশনটা বড্ড বেশি, আর মার্কিনমুলুকে থাকাকালীন সেই ইমোশনের মোশন সামলাতে রাত তিনটে অবধিও ফোনে জাগতে হয়েছে আমাদের, মানে আমাকে আর বড়দাকে।

  বড়দা কে? বড়দা, ওরফে বদ্দা, ওরফে ঘোঁতন, আমাদের বন্ধুমহলের সবচেয়ে ম্যাচিওরড্‌ ফাদারফিগার। ওর বদ্দা নামের ব্যাখ্যা খুবই সরল – বয়েসে, দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে ও আমাদের থেকে বড়।

 বড়দার সঙ্গে আমার আলাপটাও বেশ চমকপ্রদ, যেটা হয়েছিল মাসির কল্যাণে। মাসির থেকেই বদ্দার ফোন নম্বর পেয়েছিলাম। মার্কিনমুলুকে শুরুর দিকে তখন, তাই হন্যে হয়ে বাঙালি লোকজন খুঁজছিলাম, ফোনে হলেও চলবে, অ্যাটলিষ্ট বাংলায় দুটো কথা তো বলা যাবে!

  ফোন তুলে নিজের নাম জানালাম, মালটা বলল, “তাতে আমি কি করব?”

  জবাবটা শুনে মাথা থেকে পা অবধি জ্বলে গিয়েছিল, সেইসঙ্গে এটাও বুঝেছিলাম যে ব্যাটা আমার মতই হারামি! বন্ধুত্ব জমে উঠতে দেরি হয়নি, এরকম একটা মার্কামারা শুরুর পরেও প্রথমদিন আমরা ফোনে একঘন্টার ওপর হেজিয়েছিলাম।

  মার্কিনমুলুকে যে আমরা এত ঘুরে বেড়িয়েছি, তার মূল হোতা ছিল বদ্দা, কেননা ও-ই ছিল আমাদের একমাত্র ড্রাইভার। যদিও আমাদের সবার কাছেই লাইসেন্স ছিল, কিন্তু ‘অধিক চালকে যাত্রা নষ্ট’ পলিসিতে আমরা ড্রাইভিং ডিপার্টমেন্টটা ওর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। মালটা গাড়ি চালাতোও খাসা, আমার তো মাঝেমাঝেই মনে হত যে ও ভুল প্রোফেসনে আছে। ওর নিজেরও ছিল একই মত।

  পয়সার টানাটানিতে ঘুরতে যাওয়া হবেনা? তাই কখনও হয়? শুধু বদ্দাকে বলতে হত ব্যাপারটা, ও নিজের দায়িত্বে আমাকে গোটা ট্রিপ করিয়ে দিত। ফেরার দিন একটা বিল ধরিয়ে দিত বটে, কিন্তু তাতে কি? সেই বিল মেটানোর কোনো সময়সীমা ছিল না, মাঝেমাঝে অল্প করে কিছুকিছু দিলেই বদ্দা খুশ হয়ে যেত! এখনও মনে হয় কয়েকটা বিল মেটানো হয়নি আমার।

  বন্ধুবাৎসল্য ছাড়াও বদ্দার মধ্যে প্রচুর ভালভাল ব্যাপার আছে। হলি-বলি-টলি সিনেমার ওপর বেশ ভাল ফান্ডা, সাহিত্য, বিশেষ করে নন-ফিকশনের ওপর বিরাট অনুরাগ আর টোয়েন্টিনাইন খেলার বড় ভক্ত। আমরা যে বছরে দু-তিনটে করে ট্রিপ মারতাম, তার প্রধান কারণ এই টোয়েন্টিনাইন। কোনো এক রবিবাব্র বদ্দা হয়ত বলে বসল, “কি কচ্চিস? অনেকদিন টোয়েন্টিনাইন খেলা হয়নি, একটা ট্যুর করলে হয়না?”

  এখানে বলে রাখা ভাল, টোয়েন্টিনাইনে ওর পার্টনার ছিলাম আমি, আর কতবার যে ওকে ভুলভাল কল্‌ করে ক্ষেপিয়ে দিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। মালটাকে রাগিয়ে হেব্বি মজা পাওয়া যায়!

  তবে বদ্দার প্রধান টান দুটো জিনিসের প্রতি – খাওয়া, আর ঘুম। খিদে পেলে ছেলে একটু বিগড়ে যায়, তখন হাতের সামনে যা পায়, গিলতে থাকে। একবার রেস্টুরেন্টে খাবার দিতে সামান্য দেরি করছিল, বদ্দা চোঁচোঁ করে তিন লিটার আইসড টি মেরে দিয়েছিল।

  ঘুমের ব্যাপারটা আরো সরেস। যখনতখন যেখানেসেখানে বিনা নোটিসে ঘুমিয়ে পড়তে পারে বদ্দা। এরকম অনেকদিন হয়েছে যে ফোনে আড্ডা চলছে, হঠাৎ ‘ঘুঁড়ুত ঘুঁড়ুত’ শব্দ শোনা গেল। প্রথম প্রথম আমরা চমকে যেতাম, পরে বুঝেছিলাম ওটা আর কিছুই নয়, বদ্দার নাকডাকার শব্দ। ব্যাপারটা কিন্তু এখানে শেষ হত না, আমরা আরো খানিকক্ষণ আড্ডাটাড্ডা দিয়ে যখন ফোন ছেড়ে দিয়েছি, তখন হঠাৎ বদ্দার ফোন আসত।

  “কিরে, বাকিরা কোথায়?”
  “আসর ভঙ্গ হয়েছে চাঁদু, সবাই চলে গেছে”।
  “ওঃ আচ্ছা, যাঃ শালা” এটুকু বলেই ফের ঘুঁড়ুত ঘুঁড়ুত শব্দ।
  একটা কথা বলা হয়নি, বদ্দা অভিষেক বচ্চনের বিশাল ফ্যান, ওর নামে কিছু বললে স্বয়ং অমিতজিও ততটা রাগেননা, যতটা বদ্দা রাগে।

  মাইরি, মালটার এলেম আছে বটে!